Advertisement (Custom)

বিজ্ঞাপন
প্রকাশিত: বুধবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২০
সর্বশেষ সংষ্করণ 2023-12-15T14:53:11Z
গোলাপগঞ্জবিশেষ সংখ্যালিড নিউজ

গোলাপগঞ্জের সুন্দিশাইল গণহত্যা

বিজ্ঞাপন
গোলাপগঞ্জের সুন্দিশাইল গণহত্যা।  ছবি : জি ভয়েস টোয়েন্টিফোর 

জাহিদ উদ্দিন : সময়টি একাত্তরের অক্টোবর মাস। যখন চারিদিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে বাংলার মুক্তিবাহিনীর তুমুল যুদ্ধ চলছিল। এ মাসের ২৫ বা ২৬ তারিখে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে যায় গোলাপগঞ্জ উপজেলার আমুড়া ইউনিয়নের সুন্দিশাইল গ্রামে। সেইদিন সুন্দিশাইল গ্রামের ১২ জন সহ মোট ২৩জন লোককে ব্রাশ ফায়ার করে প্রকাশ্যে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহীনি।

এদিন হায়নাদের শহীদ হয়েছিলেন সুন্দিশাইল গ্রামের সরাফত আলী লস্করের পুত্র খুর্শেদ আলী, একই গ্রামের আব্দুল হামিদের পুত্র আসদ আলী, আব্দুল মজিদ মাস্টারের পুত্র তুতা মিয়া, মছির আলীর পুত্র চান্দ মিয়া, ইদ্রিছ আলীর পুত্র মুবেশ্বর আলী, আইয়ূব আলীর পুত্র কুটু চান্দ মিয়া, ওয়াজিদ আলীর পুত্র ওয়ারিছ আলী, মজর আলীর পুত্র মস্তন আলী, জছির আলীর পুত্র ওহাব আলী, রশিদ আলীর পুত্র সুনু মিয়া, ওয়াজিদ আলীর পুত্র সমুজ আলী, মাতাই মিয়া , আব্দুল গনির পুত্র আনু মিয়া, কুটলা মিয়া, মানিক মিয়া, খালিক মিয়া চন্দরপুর কালিডহর গ্রামের মিজান আলীর পুত্র মুতলিব আলী, একই গ্রামের জহির আলীর পুত্র চুনু মিয়া, ভাদেশ্বরের মীরগঞ্জের মুজম্মিল আলীর পুত্র লুলু মিয়া, রানাপিং এর মৌলভী আকাদছ আলীর পুত্র আশফাক আহমদ, অপর ৩ জন শহীদের নাম ও ঠিকানা এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

বাংলাদেশে যখন পাকিস্তানি হায়নারা আক্রমণ করে তখন বাংলার দামাল ছেলেরা সম্মিলিত ভাবে এদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে। দেশকে শত্রু মুক্ত করতে তখন গোলাপগঞ্জের সুন্দিশাইল গ্রামের বেশ কয়েক যুবক যোগদেয় মুক্তি বাহিনীতে, তুলে নেয় হাতে অস্ত্র। এ গ্রামেরই একজন বীর আব্দুস সালাম লস্কর। যুদ্ধের সময় আব্দুস সালাম লস্করের বয়স ২৪ বছর। সালাম লস্করের আপন ভাই খলিলুর রহমান লস্কর চাকুরী করতেন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীতে। যুদ্ধের সময় তিনি চাকুরী থেকে ইস্তফা দিয়ে ভাই আব্দুস সালামের সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে বাড়ি চলে আসেন।

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৫ অক্টোবর (৪ রমজান) বারপুঞ্জি ক্যাম্প থেকে ৩৬ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল উপজেলার পশ্চিম আমুড়া ইউনিয়নের সুন্দিশাইল গ্রামে এসে পৌঁছে। এখানে মুক্তিযোদ্ধারা বিশ্রাম নেন। সে সময় লস্কর বাড়ি থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার পরিবেশন করা হত। এ খাবার পরিবেশনে সাহায্য করতেন সালাম লস্করের বোন শেবু বেগম মা ও উনার স্ত্রী হালিমা খাতুন। এ খাবার মুক্তিবাহিনীর হাতে পৌছে দিতেন একই গ্রামের মরহুম মৌলা মিয়া লস্করসহ কয়েকজন। এ খবর স্থানীয় এক রাজাকার পাকিস্তানি ক্যাম্পে পৌছে দেয়।

তখন পাকিস্তানি সেনারা এলাকায় আক্রমণ চালালে মুক্তিযোদ্ধারা নিরীহ এলাকাবাসীর কথা চিন্তা করে পাল্টা আক্রমণ না করে পাশের টিলায় গিয়ে আশ্রয় নেন। পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিসেনাদের না পেয়ে তাঁদের আশ্রয়দাতা হিসেবে এলাকার ১৭ জন নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে হত্যার জন্য সুন্দিশাইলে হজরত জাহান শাহ মৌলার মাজারসংলগ্ন মোকামটিলায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায়। মুক্তিযোদ্ধারা গোপনে তা লক্ষ করছিলেন। একপর্যায়ে সুযোগ বুঝে এবং অনেকটা বাধ্য হয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালান।

এ সুযোগে আটক হওয়া লোকজন পালিয়ে গিয়ে তাঁদের জীবন রক্ষা করেন। দীর্ঘ সময় ধরে চলা পাল্টাপাল্টি আক্রমণে দুজন শহীদ হন এবং আহত হন বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। ২৬ অক্টোবর (৫ রমজান) মোকামটিলায় অবস্থিত হজরত জাহান শাহ মৌলার মাজারসংলগ্ন মসজিদে মুসলি¬রা আসরের নামাজ পড়ে বের হচ্ছিলেন।

এ সময় পাকিস্তানি বাহিনীর স্থানীয় এক রজাকারের নেতৃত্বে একদল পাকিস্তানি সেনা গণহত্যা চালিয়ে একসাথে হত্যা করে ২১জন রোজাদার সাধারণ মুসলি¬কে। এই ২১ জন শহীদের মধ্যে অনেকেই মুক্তিবাহিনীর সদস্য না হলেও দেশ স্বাধীনের রণাঙ্গনের সাথে তাঁদের কারো সন্তান বা কারো আত্মীয়স্বজন জড়িত ছিলেন।

দেশ স্বাধীনের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই ২৩শহীদ পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে একটি তাদের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। সেই সাথে তাদের পরিবারের জন্য ঢেউটিন, কম্বল ও আর্থিক সম্মানী প্রেরণ করেন।

২৩ শহীদের স্মৃতি রক্ষায় ২০০৭ সালে শহীদ পরিবারের কয়েকজন তরুণ গঠন করেন "২৩ শহিদ স্মৃতি সংসদ"। সেই সংগঠনটি ২০১০ সালে সরকারি অনুমোদন লাভ করে। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর আজও এই ২৩ শহীদের পরিবার রাষ্ট্রীয় ভাবে স্বীকৃতি লাভ করেনি। ২০১৪ সালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী বরাবরে আবেদন করলেও এখনো এ ২৩ শহীদ পরিবার স্বীকৃতির আশায় রয়েছে।

এ ব্যাপারে ২৩ শহিদ স্মৃতি সংসদ’ এর সভাপতি এম এ ওয়াদুদ এমরুল বলেন, সুন্দিশাইল গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যে ২৩ জনকে শহীদ করেছিল তাদের পরিবার এখনো রাষ্ট্রীয় ভাবে স্বীকৃতি পায়নি এটা আসলেই লজ্জার। যে ২৩ শহীদ পরিবারকে জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চিটি লিখে সম্মান জানয়েছিলেন সেই পরিবারদের রাষ্ট্রীয় ভাবে স্বীকৃতি প্রদান করতে প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহবান জানাই।
বিজ্ঞাপন

জনপ্রিয় সংবাদ