Advertisement (Custom)

বিজ্ঞাপন
প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ৭ অক্টোবর, ২০২১
সর্বশেষ সংষ্করণ 2022-05-13T12:45:28Z
গোলাপগঞ্জ

গোলাপগঞ্জে নদী ভাঙনে দিশেহারা তীরবর্তী মানুষ, ঝুঁকিতে অসংখ্য স্থাপনা

বিজ্ঞাপন
শরীফগঞ্জ ইউনিয়নের নদীতীরবর্তী এলাকার শত শত ঘর এভাবেই কুশিয়ারা নদী ভাঙ্গণের কবলে রয়েছে। ছবি : জি ভয়েস টোয়েন্টিফোর

জাহিদ উদ্দিন : সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের অনেকগুলো গ্রাম কুশিয়ারা ও সুরমা নদীর তীব্র ভাঙনের মুখে পড়েছে। ইতোমধ্যে এলাকাগুলোর বেশকিছু বসতি ও বাজারের অংশবিশেষ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।এছাড়া কুশিয়ারা ও সুরমা নদীর ভাঙনে শত শত বাড়িঘর, মসজিদ, বিদ্যালয়, হাটবাজারসহ বিস্তীর্ণ জনপদ হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ দেখার কেউ যেন নেই। এ জনপদকে রক্ষার ব্যাপারে নেই কারো কোনো উদ্যোগ।সংশ্লিষ্টরা নদীর তীর ভাঙন রোধে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

জানা যায়, উপজেলার উত্তরদিকে গোলাপগঞ্জ পৌরসভা, গোলাপগঞ্জ সদর ইউনিয়ন, বাঘা ও ফুলবাড়ি ইউনিয়নের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে সুরমা নদী। অপরদিকে, উপজেলার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বুধবারিবাজার, বাদেপাশা, শরিফগঞ্জ, ঢাকাদক্ষিণ, আমুড়া ও ভাদেশ্বর ইউনিয়নের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে কুশিয়ারা নদী। এই দুই নদীর একেক জায়গায় একেক রূপ। সুরমা ও কুশিয়ারা ভাঙনে নদী গর্ভে বসতবাড়ি, ফসলি জমিসহ বিলীন হচ্ছে ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

এলাকাবাসীর অভিযোগ ড্রেজার দিয়ে অপরিকল্পিত ভাবে বালু উত্তোলন ও নদীর পারে ব্লক না থাকাই এ সর্বনাশের কারণ। নদী তীরের মানুষের ভাঙন নিত্য দিনের এক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

উপজেলার সুরমা তীরবর্তী বাঘা ইউনিয়নের শতাধিক ঘরবাড়ি সুরমা নদীর গর্ভে চলে গেছে। এ ইউনিয়নের শুধু রস্তপুর এলাকার প্রায় অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি সুরমার ভাঙনের কবলে বিলীন হয়ে গেছে। অনেকের বসতের আর জমি না থাকায় গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র বসবাস করছেন। আবার অনেকে বাসা ভাড়ায় বসবাস করছেন।গ্রামবাসী জানান, রস্তমপুর গ্রামের মাস্টার আব্দুর রহমান মাস্টার আব্দুছ সুবহান, মজির উদ্দিন, মছব্বির আলী ও ডাক্তার আমির উদ্দিনের বসটভিটা ও গাছগাছালি সুরমা নদী গ্রাস করে ফেলেছে। অসহায় এসব লোকজন যে যেদিকে সম্ভব হয়েছে অন্যত্র চলে গেছেন।

বাঘা ইউনিয়নের রস্তুমপুরে সুরমা নদীর ভাঙ্গণে এভাবেই বিলীন হচ্ছে শত শত বাড়ি। ছবি : জি ভয়েস টোয়েন্টিফোর

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রুস্তমপুর পুরান জামে মসজিদ, হাতিমনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের রাস্তা, রুস্তমপুর হাফিজিয়া মাদ্রাসা, রুস্তমপুর পশ্চিম পাড়া জামে মসজিদ, স্থানীয় গোরস্তান ও নদীপারের রাস্তাটি রয়েছে অতি ঝুঁকির মধ্যে। এরমধ্যে এসব স্থাপনার কোন কোন স্থানের বড় একটি অংশ বিলীন হয়ে গেছে। নদী পারের রাস্তাটি ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই।

এলাকাবাসী জানান, দীর্ঘ দিন থেকে সুরমা নদীর ভয়াবহ তাণ্ডবলীলায় একের পর এক নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে ঘরবাড়ি সহ বিভিন্ন স্থাপনা।বাঘা সোনাপুর এলাকার তারেক আহমদ জানান, শুধু রস্তমপুর এলাকা নয়, পার্শ্ববর্তী এলাকা ঘনশ্যাম ও শুকনা এলাকাও অবৈধভাবে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের কারণে রয়েছে চরম ঝুঁকির মধ্যে। এ ইউনিয়নের প্রাচীনতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাঘা গোলাপনগর মাদ্রাসা, পূর্ব বাঘা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহ নদী পারের সবকটি বসতবাড়ি রয়েছে সুরমার ভাঙনের ঝুঁকির মধ্যে।সুরমা নদীর প্রবল স্রোতে উপজেলার ঐতিহাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমসি একাডেমি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের উত্তর পাশ ও রাণাপিং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীরে বিশাল ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙন প্রতিরোধ করতে না পারলে যে কোনো সময় এই দুটি প্রতিষ্ঠানের সিংহভাগ ভবনসহ প্রতিষ্ঠান বিলীন হতে পারে।

বাঘা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছানা মিয়া জানান, ইউনিয়নে নদী ভাঙ্গন রোধে সরকারের পক্ষ থেকে কোন বরাদ্দ দেওয়া হয়না। এজন্য আমরা নদী ভাঙ্গন রোধে কিছু করতে পারিনা।এদিকে কুশিয়ারার নদী ভাঙ্গনে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে উপজেলার শরিফগঞ্জ, বাদেপাশা, বুধবারীবাজার ইউনিয়ন এবং আমুড়া ও ভাদেশ্বর ইউনিয়নের একাংশ। কুশিয়ারার অব্যাহত নদী ভাঙ্গনের কারণে এ ৪টি ইউনিয়নের নদীর তীরবর্তী অসংখ্য বাড়িঘর রয়েছে হুমকির মুখে। বদলে যাচ্ছে এসব ইউনিয়নের মানচিত্র।

নদীর তীর ঘেঁষা শরীফগঞ্জ ইউনিয়নের খাটকাই-মেহেরপুরের ব্যস্ততম সড়কটি নদী ভাঙ্গনে বিলীন হওয়ার পথে। এতে ঝুঁকি নিয়ে চলতে হচ্ছে পথচারীদের। কখন যেন নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায় ব্যস্ততম ওই সড়কটি এমন আশংকা সাধারণ মানুষের। ইতিমধ্যেই পনাইচক জামে মসজিদ ও উচ্চ বিদ্যালয়ের নিকটস্থ রাস্তাটি পুরোপুরি নদী গর্ভে চলে গেছে। এ রাস্তাটি নদী গর্ভে চলে যাওয়ায় বিপাকে রয়েছেন পনাইর চক উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ সে সব এলাকার মানুষজন।

শরিফগঞ্জ ইউপির চেয়ারম্যান এম এ মুহিত হিরা জানান,পনাইর চক স্কুলের নিকটবর্তী রাস্তাটি নদী ভাঙ্গনে পুরোপুরি নদী গর্ভে চলে গেছে। অন্য পাশ দিয়ে বিকল্প রাস্তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।নদী ভাঙ্গনে হুমকির মুখে রয়েছে এ এলাকার ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ পনাইর চক উচ্চ বিদ্যালয়টিও।

এ ইউনিয়নের স্থানীয় লোকজন জানান, ইতিমধ্যে কুশিয়ারা নদী ভাঙনের শিকার হয়ে খাটকাই-পনাই চক গ্রামের শত শত পরিবার নিঃস্ব হয়েছে। অনেকেই বাড়িঘর হারিয়ে অন্যত্র বসবাস করে আসছেন। নদী তীরবর্তী ফসলের জমি হারিয়ে যাচ্ছে।অসংখ্য গাছপালা চলে গেছে নদী গর্ভে।নদীর অব্যাহত ভাঙ্গনে আরও অসংখ্য বাড়িঘর ও স্থাপনা বিলীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নদীতে ভাঙ্গন দেখা দেয়ায় এ ইউনিয়নের এসব এলাকার লোকজন আতংকে দিন কাটাচ্ছেন। এ ইউপির মেহেরপুর বাজার (কালাবাজার), কাদিপুর বাজার, নয়া বাজার সহ বেশ কয়েকটি বাজারের দোকান কুশিয়ারা নদীতে ধসে পড়েছে। কুশিয়ারা নদী ভাঙ্গনে প্রায় বিলীন হওয়ার পথে এসব বাজার।এতে নদী তীরবর্তী মার্কেটের ব্যবসায়ীরা রয়েছেন আতংকে। 

বুধবারী বাজার ইউনিয়নের কালিজুরি, চন্দরপুর বাজার থেকে লামাচন্দরপুর, বনগাঁও থেকে বুধবারিবাজার ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত চরম ভাঙ্গনের মধ্যে রয়েছে। হুমকির মুখে রয়েছে এলাকার অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাঘিরঘাট উচ্চ বিদ্যালয়। লামাচন্দরপুর এলাকার বিশাল অংশ নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বসতভিটা হারিয়ে মানুষ অন্যের বাড়িতে, হাওরে অথবা খুপড়িঘরে আশ্রয় নিয়েছেন। 

কুশিয়ারার করাল গ্রাসে নিঃস্ব সমছুল হক আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেন, বাড়িঘর সব শেষ। আর কোন জমিও নেই তাই অন্যত্র বসবাস করছি।ননদীর দিকে অঙ্গুল দিয়ে তিনি বলেন, ঐ যে পানি দেখছেন ঐখানেই ছিল আমার বাড়ি। এখন অন্যের জায়গায় একটি টিনের চালা তৈরি করে পরিবার নিয়ে থাকি। এই এলাকার শুধু সামছুল হক নয়, আব্দুস সুবহান, আব্দুল রহীম, আব্দুল লতিফ, সমছুল হক, লাল মিয়া, সাব উদ্দিন, হারুন মিয়া, ওলি মিয়া, খালেদ মিয়া, মারুফ মিয়া, আহাদ মিয়া, ফরহাদ মিয়া, রইব আলী,বাছন আলী, হাছন আলো, জসিম উদ্দিন, শহীদ, ছোটন মিয়া সহ অনেকেই নদী ভাঙ্গনের কারণে ভিটে মাটি হারিয়ে আজ নিঃস্ব। 

এদিকে বাদেপাশা ইউনিয়নের হাজিরকোনা গ্রাম থেকে ডেপুটিবাজার-মফজ্জিল আলী দ্বিপাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয়, বাগলাছঘরি হতে বাগলা বাজার এবং আছিরগঞ্জ খাল থেকে আমকোনা মাজার এই ৩টি পয়েন্ট ভয়াবহ ভাঙ্গনের মধ্যে রয়েছে। ইতিমধ্যে অনেক বাড়ি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। 

এলাকার হুমকির মুখে রয়েছে মফজ্জিল আলী দ্বিপাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয় ও গুরুত্বপূর্ণ বাগলা বাজার। ভাঙ্গনে এলাকার গুরুত্বপূর্ণ বসন্তপুর-কটলিপাড়া সড়কের বাঘলাবাজার সংলগ্ন অংশে ফাটল দেখা দিয়েছে। যেকোনো সময় সড়কটির এই অংশ ধসে পড়ার আশংকার কথা জানান এলাকাবাসী। সুরমা ও কুশিয়ারা নদী ভাঙ্গন অভিশাপ থেকে রক্ষা পেতে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন ভাঙন রোধে পদক্ষেপ নিতে সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন। বাদেপাশা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মস্তাক আহমদ জানান, কুশিয়ারা নদীর ভাঙ্গনে চোখের সামনে অনেক ঘরবাড়ি হারিয়ে গেছে। নদী ভাঙ্গন রোধে কোন বরাদ্দ না আসায় আমরাও কিছু করতে পারিনা। 

এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের উপ-সহকারী প্রকৌশলী (বিয়ানীবাজার-গোলাপগঞ্জ) মো. আসাদুজ্জামান জানান, ভাঙ্গনের শিকার বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন চাহিদানুযায়ী নাম উল্লেখ করে কারিগরি কমিটি গঠনের প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়েছে। সেই কমিটি পিপিপি দাখিল করলে তার ভিত্তিতে একনেকে প্রকল্প অনুমোদন হলে নদী ভাঙ্গন রোধে কাজ শুরু হবে। এই প্রস্তাবের মধ্যে গোলাপগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকার নাম রয়েছে বলেও জানান তিনি ।
বিজ্ঞাপন

জনপ্রিয় সংবাদ