বিজ্ঞাপন
স্টাফ রিপোর্ট : আজ ১৫ ডিসেম্বর। সিলেট মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে পূর্বাঞ্চলীয় জেলা সিলেট মুক্ত হয়েছিল।
৭১’ এর ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় মুক্তিযোদ্ধারা বীরের বেশে সিলেট শহরে আসতে শুরু করে। অন্যদিকে পরাজয় নিশ্চিত জেনে পালাতে শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর আলবদর, রাজাকার, আল-শামস বাহিনীর সদস্যরা।
ভারত ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এরপর সিলেট শহরে পাক হানাদার বাহিনীর বিভিন্ন ঘাঁটির ওপর বিমান হামলা চালায় ভারত। এই হামলা ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো। ১৩ ডিসেম্বর দুপুরে মুক্তিবাহিনীর একটি দল খাদিমনগর এলাকায় এসে অবস্থান নেয়। একই দিন মুক্তিযোদ্ধাদের আরও কয়েকটি দল দক্ষিণ জালালপুর ও পশ্চিম লামাকাজিতে আসে। তখন ফাঁকা ছিলো শুধু উত্তর দিক। কিন্তু সেদিকে সীমান্তবর্তী পাহাড়, বনাঞ্চল থাকায় দোসরদের পালাবার কোনো পথ ছিলো না।
হঠাৎ দু’জন তরুণ বীর মুক্তিযোদ্ধা ফোরকান আলী (কুটু মিয়া) ও আনোয়ার হোসেন গোরা খাদিমনগর থেকে একটি গাড়িতে চড়ে পাকিস্তানি দোসরদের আত্মসমর্পণের জন্য বেশ কয়েক ঘণ্টা শহরে মাইকিং করতে থাকেন। তাদের সেই মাইকিংয়ের মধ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মনে নতুন করে সাহসের সঞ্চার হয়। তখন উত্তপ্ত সিলেট শহর।
মাইকিং করতে করতে সাহসী দুই মুক্তিযোদ্ধা ক্রমান্বয়ে শহরের দিকে আসেন। এ সময় বাসা-বাড়ি, দোকানপাটে থাকা উদ্বিগ্ন মানুষ দুই মুক্তিযোদ্ধার কণ্ঠে শুনতে পেয়ে রাস্তায় নেমে এসে তাদের স্বাগত জানায়। অনেকেই তাদের উদ্দেশ্যে শ্লোগান তোলেন। যে গাড়িতে মাইকিং চলছিল সেই গাড়ির পেছনে আরেকটি গাড়িতে করে শহরের দিকে আসছিলেন মুক্তিযুদ্ধের উত্তর অঞ্চলের বেসামরিক উপদেষ্টা ও তৎকালীন জাতীয় পরিষদ সদস্য প্রয়াত দেওয়ান ফরিদ গাজী ও মিত্র বাহিনীর অধিনায়ক কর্ণেল বাগচী।
শহরের যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে লোকজন বিস্ময় দৃষ্টি নিয়ে তাদের দেখছিলেন। তখন হানাদারদের অবস্থান ছিলো সিলেট সরকারি কলেজের আশপাশে। প্রকাশ্যে আসতে না পারলেও গোপনে তারা সংগঠিত হয়ে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু মাইকিং করার পর শত্রুরা আত্মসমর্পণের বিষয়টিকে উড়িয়ে দেয়। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের খাদিমনগরের দিকে ফিরে যেতে হয়।
ওই দিন কদমতলী এলাকায় ঘটে আরেক ঘটনা। একটি ইটখোলায় থেকে যাওয়া ২১ জন পাকিস্তানি সেনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর সদস্যরা। ওই দলের সঙ্গে সেদিন মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল হক, গামা, আফরাইন, আব্দুল মতিন, ম.আ. মুক্তাদির, মনির উদ্দিন, ইশতিয়াক আহমদ, বেলায়েত হোসেন, বেলায়েত হোসেন খান, জামানসহ ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলা করেছিলেন শত্রুদের। সেদিনের অপারেশনে নেতৃত্ব দেন রানা নামে এক ভারতীয় সুবেদার। প্রায় ৯ ঘণ্টা সম্মুখ যুদ্ধের পর নিরুপায় হয়ে পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পনের পথ বেছে নেয়।
মাছিমপুর থেকে নিক্ষিপ্ত একটি শক্তিশালী মর্টারের আঘাত করে সুবেদার রানাকে। তিনি শহীদ হন। আহত হন মিত্র বাহিনীর আরও দুই সদস্য। তবে, তাদের নাম সেদিন জানা ছিলো না কারো।
পরে ১৪ ডিসেম্বর সরকারি কলেজের আশপাশ থেকে শত্রুরা তাদের অবস্থান তুলে নেয়। দুপুরে দেওয়ান ফরিদ গাজী ও কর্নেল বাগচী বিনা প্রতিরোধে শুধু শহরেই নন, বিমানবন্দরের পাশে গড়ে ওঠা শত্রুদের মূল ঘাঁটির কাছাকাছি পর্যন্ত ঘুরে আসেন।
ইতোমধ্যে ‘জেড’ ফোর্স’র সেনারা এমসি কলেজ সংলগ্ন আলুতলে সরকারি দুগ্ধ খামারের কাছে পৌঁছে যায়। তখন পাকিস্তানি সেনারা সবদিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় চারদিক থেকে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর জওয়ানরা দলবদ্ধভাবে শহরে প্রবেশ করতে শুরু করেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের কোলাহলে মুখর হয়ে ওঠে সিলেট শহর। পাড়া-মহল্লা, অলিগলি পর্যন্ত এই খবর পৌঁছে যায়। ‘জয় বাংলা, জয় বাংলা’ স্লোগানে ভারী হয়ে ওঠে সিলেটের মাটি। অবস্থা বেগতিক দেখে রাতেই গা ঢাকা দিতে শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনীর এদেশীয় দোসররা। পরদিন ১৫ ডিসেম্বর সকালে সব বয়সী মুক্তিপাগল মানুষের ঢল নামে সিলেট শহরে। মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতে ভিড় জমে পথে পথে।
ঘড়িতে তখনো ১২টা বাজেনি। শহরবাসী মাইকের মাধ্যমে উচ্ছ্বাস ভরা কন্ঠে গোটা সিলেটে প্রচার করতে থাকেন ‘সিলেট হানাদার মুক্ত’ সিলেট হানাদার মুক্ত’। সেই থেকেই ১৫ ডিসেম্বর সিলেট মুক্ত দিবস পালিত হয়ে আসছে।