বিজ্ঞাপন
সুলতান সুমন: ছেলে হারিয়ে মায়ের আর্তনাদ। ছোট্ট শিশুর কান্না। আর স্ত্রীর আহাজারি, কেউই থামাতে পারছে না। টগবগে যুবক রায়হান। অসুস্থ শিশুর জন্য দুধ ও ঔষধ নিয়ে আসার কথা ছিল। কিন্তু আর ফেরেননি ঘরে। নির্যাতনে তার মৃত্যু হয়েছে। শরীরে রয়েছে অসংখ্য লাঠির আঘাত। হাতের আঙ্গুলের নখ উপড়ানো, পায়ের ঘোড়ালি ও মাসুল কাটা এমনই তথ্য জানিয়েছেন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিনের বিভাগীয় প্রধান ও সহকারি অধ্যাপক ডাক্তার শামসুল ইসলাম। তিনি জানান, রায়হানের পোস্ট মোর্টেম হয়েছে। তাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মারপিটের কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে।
রোববার ভোর ৪টা ২৩ মিনিটের দিকে রায়হানের মায়ের মোবাইল ফোনে ০১৭৮৩ ৫৬১১১১ নম্বর মোবাইল থেকে কল দিয়ে রায়হান জানায় পুলিশ তাকে ধরে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে নিয়ে এসেছে। এখন তার কাছে ১০ হাজার টাকা ঘুষ চাচ্ছে। টাকা দিলে পুলিশ তাকে ছেড়ে দেবে। এ সময় কেঁদে কেঁদে রায়হান তাকে বাঁচানোর আকুতি জানায়। ওই মোবাইল নম্বরটি বন্দর ফাঁড়ির কনস্টেবল তৌহিদের।
ছেলেকে পুলিশে ধরেছে শুনে রায়হানের মা তার চাচাকে ৫ হাজার টাকা দিয়ে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে পাঠায়। রায়হানের চাচা টাকা নিয়ে রায়হানকে ছাড়িয়ে আনতে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে যান। কিন্তু ১০ হাজার টাকার বদলে ৫ হাজার টাকা নিয়ে আসার অপরাধে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন করে হত্যা করা হয় রায়হানকে।পুলিশি নির্যাতনে নিহত যুবক রায়হান আহমদ সাবেক বিডিআর কর্মকর্তার সন্তান। রায়হান নিহত হওয়ার পর থেকে সিলেট জুড়ে হচ্ছে জনতার আন্দোলন। নিহতের স্ত্রী বাদী হয়ে আদালতে করেছেন মামলা। প্রাথমিকভাবে এ ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে ফাঁড়ির ইনচার্জসহ ৪ পুলিশকে বরখাস্ত এবং তিন পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করেছে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ। তবে এ ঘটনায় জড়িত কাউকে এখনও গ্রেফতার করা হয়নি।
রায়হান আহমদের মা সালমা বেগম ও চাচা হাবিবুল্লাহ অভিযোগ করেন, কর্মস্থল চিকিৎসকের চেম্বার থেকে ফিরতে দেরি দেখে শনিবার রাত ১০টায় রায়হানের মোবাইলে ফোন দেন মা ও স্ত্রী। কিন্তু ফোন বন্ধ পান। ভোর ৪টা ২৩ মিনিটের দিকে মায়ের মোবাইল ফোনে অপরিচিত একটি নাম্বার থেকে কল দিয়ে রায়হান জানায় পুলিশ তাকে ধরে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে নিয়ে এসেছে। এখন তার কাছে ১০ হাজার টাকা ঘুষ চাচ্ছে। টাকা দিলে পুলিশ তাকে ছেড়ে দিবে।
এ কথা শুনে রায়হানের মা তার চাচাকে ৫ হাজার টাকা দিয়ে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে পাঠান। রায়হানের চাচা হাবিবুল্লাহ রবিবার ফজরের সময় টাকা নিয়ে ভাতিজা রায়হানকে ছাড়িয়ে আনতে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে যান।
এসময় সাদা পোষাকে ফাঁড়িতে থাকা এক পুলিশ সদস্য বলেন, ‘আপনার ১০ হাজার টাকা নিয়ে আসার কথা। আপনি ৫ হাজার টাকা নিয়ে আসলেন কেন? চলে যান, রায়হান এখন ঘুমাচ্ছে এবং যে পুলিশ কর্মকর্তা তাকে ধরে নিয়ে এসেছেন তিনিও ফাঁড়িতে নেই। আপনি ১০ হাজার টাকা নিয়ে সকাল ৯টার দিকে আসেন। আসলেই তাকে নিয়ে যেতে পারবেন। তাকে আমরা কোর্টে চালান করবো না। ’
এ কথা শুনে রায়হানের চাচা বাসায় চলে যান এবং পরে সকাল ৯টার দিকে টাকা নিয়ে ফের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে যান। এসময় পুলিশ সদস্যরা জানান, অসুস্থ হয়ে পড়ায় সকাল ৭টার দিকে রায়হানকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ খবরে হাবিবুল্লাহ উদ্বিগ্ন হয়ে তৎণাৎ ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন রায়হানের লাশ মর্গে রাখা হয়েছে। ময়না তদন্তের পর বিকেল ৩টার দিকে পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করে।
‘পুলিশি নির্যাতনে’ রায়হানের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে তার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও স্থানীয় লোকজন রোববার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের আখালিয়া এলাকায় সড়ক অবরোধ করেন। প্রায় আধাঘন্টা সড়ক অবরোধের পর পুলিশ গিয়ে তাদেরকে শান্ত করে সড়ক থেকে সরিয়ে দেয়।
এদিকে স্থানীয় কাউন্সিলর সহ এলাকার মানুষজন বলছেন নিহত রায়হান অত্যন্ত নম্র, ভদ্র ছেলে ছিল। তাকে মিথ্যা নাটক বানিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
এদিকে রবিবার ভোরে রায়হানের মৃত্যুর পর পুলিশের প থেকে জানানো হয়েছিল ছিনতাইকালে নগরীর কাস্টঘর এলাকায় গণপিটুনিতে রায়হানের মৃত্যু হয়েছে। তবে পরিবারের প থেকে নির্যাতনে মৃত্যুর অভিযোগ তোলার পর তদন্তে নেমেছে পুলিশ।
সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (গণমাধ্যম) জ্যোর্তিময় সরকার জানান, রায়হানের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে তদন্ত চলছে। তদন্তে পুলিশের কেউ জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অপরদিকে,‘পুলিশি নির্যাতনে’ নিহত রায়হানের বাসায় যান সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। সোমবার (১২ অক্টোবর) সন্ধ্যায় নগরীর আখালিয়া এলাকার নেহারিপাড়াস্থ রায়হানের বাসায় যান তিনি।
মেয়রকে দেখে রায়হানের মা সালমা বেগম ও স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং ‘হত্যাকারীদের’ ফাঁসি চান। এসময় আরিফুল হক চৌধুরী তাদের সান্তনা এবং দোষীদের শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন।পরে রায়হানের আড়াই মাস বয়সি কন্যাসন্তান আলফাকে কোলে নিয়ে নিজেও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।
স্বামী নিহতের ঘটনায় স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি মামলায় উল্লেখ করেন, প্রতিদিনের মতো গত শনিবার (১০ অক্টোবর) বিকাল ৩টার দিকে তার স্বামী রায়হান আহমদ নিজ কর্মস্থল নগরীর স্টেডিয়াম মার্কেটস্থ ডা. গোলাম কিবরিয়া ও ডা. শান্তা রাণীর চেম্বারে যান। পরদিন (১১ অক্টোবর) ভোর ৪টা ৩৩ মিনিটে ০১৭৮৩৫৬১১১১ মোবাইল নাম্বার থেকে শ্বাশুড়ি (রায়হানের মা সালমা বেগম)-এর ব্যবহৃত মোবাইল নাম্বার (০১৭৮৭৫৭০৯৪৯)-এ কল দিলে সেটি রিসিভ করেন রায়হানের চাচা হাবিবুল্লাহ।
এসময় রায়হান আর্তনাদ করে বলেন, তিনি বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে আছেন। তাঁকে বাঁচাতে দ্রুত টাকা নিয়ে বন্দর ফাঁড়িতে যেতে বলেন রায়হান। এ কথা শুনে রায়হানের চাচা ভোর সাড়ে ৫টার দিকে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে রায়হান কোথায় জানতে চাইলে দায়ত্বিরত একজন পুলিশ বলেন, সে ঘুমিয়ে গেছে। আর যে পুলিশ রায়হানকে ধরে নিয়ে এসেছেন তিনিও চলে গেছেন। এসময় হাবিবুল্লাহকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ফাঁড়িতে আসার কথা বলেন ওই পুলিশ। পুলিশের কথামতো হাববিুল্লাহ আবারও সকাল পৌনে ১০ টার দিকে ফাঁড়িতে গেলে দায়িত্বরত পুলিশ জানান, রায়হান অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে এম.এ.জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
সঙ্গে সঙ্গে রায়হানের চাচা ওসমানী হাসপাতালে গিয়ে জরুরি বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, রায়হানকে সকাল ৬ টা ৪০ মিনিটে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং সকাল ৭ টা ৫০ মিনিটে তিনি মারা যান। এসময় হাবিবুল্লাহ পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনকে খবর দিলে তারা গিয়ে ওসমানীর মর্গে রায়হানের ত-বিত লাশ দেখতে পান।
তানিয়া আক্তার তান্নি মামলায় আরও বলেন, তার স্বামীকে কে বা কারা বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে গিয়ে পুলিশি হেফাজতে রেখে হাত-পায়ে আঘাত করে এবং হাতের নখ উপড়ে ফেলে। পুলিশ ফাঁড়িতে রাতভর নির্যাতনের ফলে স্বামী মৃত্যুবরণ করেন।