Advertisement (Custom)

বিজ্ঞাপন
প্রকাশিত: রবিবার, ২৯ আগস্ট, ২০২১
সর্বশেষ সংষ্করণ 2022-10-18T20:43:04Z
সাহিত্য

হৃদয় মাঝে অচিন পাখি : জয়নাল আবেদীন

বিজ্ঞাপন

বিছনাকান্দী থেকে সিলেট শহরে ফিরছি। সকাল ৮ ঘটিকা। অফিস করতে হবে তাই তাড়াহুড়ো করে ফিরা। গাড়িতে বসে আছি একা। একটি ফুটফুটে চেহারার ছেলে এক জোড়া কবুতর নিয়ে গাড়ির পাশে এসে সালাম দিয়ে বললো ভাইয়া কবুতর কিনবেন?

তার মিষ্টি কন্ঠে ভাইয়া ডাক শুনে অবাক নয়নে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, নেবো কত দিতে হবে?

- ভাইয়া ৫০০ টাকা। 

তাকালাম কবুতরের দিকে বেশ সুন্দর সাদা রঙের গলায় সোনালী রঙের হালকা আঁচ। মনে হচ্ছে গহনা পড়া। বললাম, এতো টাকা তো দর হয় হয় না। কম কত দিলে হবে?

- ভাইয়া ৫০০ টাকাই দেন। এটা বিক্রির টাকা দিয়ে আমার আপু শহরে পরীক্ষা দিতে যাবে। গাড়ি ভাড়া দিয়ে যাবে, কম হলে আটকে যাবেন। আপুর কাছে আর কোন টাকা নেই।

ঠিক আছে দিয়ে দাও। পকেট থেকে ৫০০ টাকার নোট বের করে তার হাতে দিলাম। জিজ্ঞাস করলাম তোমার নাম কি?

- জ্বি ভাইয়া আমার নাম অর্নব।
বাহ, সুন্দর নাম তো! কিসে পড়ো? 

- ভাইয়া আমি ৫ ম শ্রেণীতে পড়ি।

তোমার আব্বু কি করেন? কথাটা শুনে নীরব হয়ে গেল অর্নব। জিজ্ঞাস করলাম কোন সমস্যা ? 

- ভাইয়া আব্বু গত বছর প্রবাসে মারা গেছেন। বলে চোখের পানি ফেলে দিলো। 

আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম, কাঁদে না ভাই আমার।

- সহজ সরল কন্ঠে বললো জানেন ভাইয়া, আব্বু মারা যাবার পর মা আপু আর আমরা দু’ভাই এর পরিবার। আপু দেখা শোনা করেন। টিউশনী আর ব্রাক স্কুলে পড়াইয়া, যা পান তা দিয়ে সংসার চালান। আমার আপুর জন্য দোয়া করবেন আজ আপু শহরে যাবে পরীক্ষা দিতে। আমার আপুর যদি চাকরী হয় আপনাকে সবার আগে মিষ্টি খাওয়াবো। 

ভাবলাম বোকা ছেলে কত সহজ সরল! আমাকে সে পাবে কোথায়। পকেট থেকে ১০০ টাকার নোট বের করে দিয়ে বললাম, আমি তোমার ভাইয়া এই টাকাটা রাখো। কিছু খেয়ে নিও। নিতে চাইলো না। 

- বলে, নেবো না আম্মু আর আপু শুনলে বকা দেবে। আমি নিতে পারবো না। 

আমি তাকে জোর করে দিলাম। বললাম, তোমার আম্মু যদি জিজ্ঞাসা করেন, তাহলে বলো তোমার এক বড় ভাই দিয়েছে। অর্নব চলে যাচ্ছে কবুতর গুলি কেমন করে ডেকে উঠলো। তারা তাকিয়ে দেখছে অর্নবের চলে যাওয়া। অর্নবও বার বার ফিওে তাকাচ্ছে। আমার আর কবুতরের দিকে। 
একা বসে আছি সিএনজিতে। চোখ পড়লো গাড়ীর সামনের সাইটের গ্লাসের দিকে। হিজাব পড়া একটি মেয়ে ফাইল হাতে নিয়ে গাড়ির দিকে আসছে। এসে গাড়িতে উঠে বসলো। ড্রাইভারকে জিজ্ঞাস করলো গাড়ি ভর্তি হতে কত সময় লাগবে।

- ড্রাইভার বললো, ঠিক নাই ঘন্টা খানিক ও লাগতে পারে। মেয়েটি ড্রাইভারকে বললো আমার পরীক্ষা ছিলো ১১টায়। আমি ড্রাইভারকে বললাম আমারও অফিসের সময় চলে আসতেছে, গাড়ি ছেড়ে দাও বাকি ভাড়া আমি দিয়ে দিবো। কথা শুনে মেয়েটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বললো, ধন্যবাদ আপনাকে গাড়ি পূর্ণ না হলে ছাড়া যাবে না। শুনে ভাবছিলাম আজ হয় তো পরীক্ষা দেয়া হবে না। বললাম, না ঠিক আছে আমারও তো অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। কিসে পরীক্ষা দেবেন? 

- ব্যাংকে।

চোখ পড়লো কবুতরের দিকে। যেন খাঁচা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে মেয়েটির দিকে। মেয়েটি জিজ্ঞাস করলো, কবুতর কিনেছেন বুঝি?
হ্যা, আমার কবুতর বেশ প্রিয়। গাড়িতে বসেছিলাম একজন ছোট ভাই এসে বললেন কিনবো কিনা। দেখে ভালো লাগলো তাই কিনে নিলাম। 

কি সুন্দর না কবুতর দুটি? 

জ্বি খুব সুন্দর। যার কাছ থেকে কিনেছি ছেলেটি বেশ মিষ্টি করে কথা বলে। দেখতেও বেশ মিষ্টি চেহারা। সহজ সরল ভাবে কথা বলে। আমি যদি এখানে থাকতাম প্রতিদিন তার সাথে কথা বলতাম। শহরের ধান্দাবাজ মানুষের সাথে উঠা বসা করতে করতে ভুলেই গিয়েছিলাম যে এতো সহজ সরল মানুষ আমাদের মাঝে আছে। 
মেয়েটি নিরবে আমার কথা শুনছে আর কবুতরের দিকে তাকিয়ে আছে। 

- প্রশ্ন করলো মেয়েটি আমাকে আপনার বাসা কোথায়? কি জব করেন? আমার বাসা শহরেই আর আমি একটা প্রাইভেট ফার্মে জব করি।

- কবুতর গুলিকে আটকে রাখছেন কেন?

আমি একটু অবাক হলাম! বললাম, অচিন পাখি খাঁচায় আটকে রাখতে হয়। কিছু দিন বন্দি থাকলে আপন হয়ে যায় ছেড়ে দিলে পালায় না আর। কবুতর গুলা আজ নতুন কিনলাম ছাড়লে উড়ে যাবে তো তাই। 

- আরে যাবে না বলে মেয়েটা খাঁচার দরজা খুলতে লাগলো।

আমি বললাম আরে কি করছেন! উড়ে যাবে তো! 

কে কার কথা শুনে। কবুতর দুটিও যেন মেয়েটির কাছে আসতে চায় খাঁচা ভেঙ্গে। দরজা খুলে দিতেই কবুতর দুটা মেয়েটার বুকে এসে গলায় লুকালোনোর চেষ্টায় ব্যস্ত। আমি তো দেখে অবাক!

কবুতর দুটি আমার পোষা ছিলো বিপদে পড়ে আজ বিক্রি করতে হলো। বলতেই মেয়েটি চোখের জল টল টল করে পড়তে লাগলো। আমার বুঝতে আর বাকি রইলাম না সে মিষ্টি ভাই অর্নবের বোন। জিজ্ঞাস করলো আমায়
আপনি কি কৈতর দুটাকে জবাই করে খেয়ে নেবেন? বলে জড়িয়ে ধরলো দুটাকে।

আমি অবাক নয়নে শুধু দেখছি নিশ্চুপ বোবার মতো। কিছুক্ষন পরে বললাম, আপনি শান্ত হোন। আমি পাখির মাংস খাইনা। এগুলা কিনেছিলাম পালনের জন্য। আপনি তাহলে অর্নবের বোন? 
চোখ মুছে কবুতর দুটিকে কোলে বসিয়ে বললো, জ্বি।

কি নাম আপনার? আমার নাম অর্পিতা।
অর্নবকে আমার বেশ ভালো লেগেছে। আপনারা আসলে সহজ সরল চিন্তা করবেন না। আপনি আগে পরিক্ষা দেন আপনার কৈতরের কিছু হবে না। শুনেছি, অর্নব বলেছে আপনি ব্রাক স্কুলে পড়ান? 

- জ্বি পড়াই। শহরে খালার বাসায় থেকে এমবিএ করলাম। হঠাৎ করে বাবা মারা গেলেন, খালাও প্রবাসে চলে গেলেন। সেখানে যাওয়ার কিছু দিন পরে খালাও মারা গেলেন। এক ভূমি খেকুর কবলে পড়ে সব জমি জমা হারালাম। আছি আর কি, মা আর ছোট দু ভাইকে নিয়ে। 

কথা বলতে বলতে গাড়ি এসে শহরে পৌছালো। নেমে রেস্টুরেন্টে ঢুকে নাস্তা করে পরে একটা রিকশা করে পরীক্ষা কেন্দ্রে নিয়ে গেলাম। অর্পিতাকে পরীক্ষার হলে ডুকিয়ে দিয়ে বসে থাকলাম বাহিরে। পরিক্ষা দিয়ে বেরিয়ে এলো সে। আমি এই ফাঁকে কবুতরের জন্য খাবার কিনে নিয়ে এলাম কিন্তুু কোন মতে খাওয়াতে পারলাম না। অর্পিতা আসার পর বললাম, আমি খাওয়াতে পারিনি আপনি খাওয়ান তো। খাঁচার দরজা খুঁলে অর্পিতা কৈতর দুটিকে হাতে তোলে নিয়ে এসে খাইয়ে দিলো।

জিজ্ঞাস করলাম পরীক্ষা কেমন হলো?

- বেশ হয়েছে।

থাকবেন কি আজ শহরে? হেসে বললো, কে আছে আমার এখানে আমায় রাখবে।

দুপুরে খেয়ে তাকে গাড়িতে তোলে দিতে গেলাম। গাড়িতে তোলে দিয়ে কৈতর দুটা হাতে দিয়ে বললাম নিয়ে যান বাড়িতে ওরা আপনাকে ছাড়া থাকবে না। কিন্তু কিছুতেই দিতে পরলাম না। উনি নেবেন না। অসহায় হয়ে নিয়ে আসতে হলো। বাসায় এসে রেখে বাহিরে গেলাম রাতে বাড়ি ফিরে কোন মতেই খাওয়াতে পারলাম না। 

সকালে উঠে অফিসে চলে গেলাম। দুপুরে মায়ের ফোন। কবুতর দুটা জিমাচ্ছে কিছু খাচ্ছে না। মায়ের কথা শুনে সোজা বাসায় এসে কবুতর দুটা নিয়ে চলে গেলাম। তাদের বাড়ি খোঁজে বের করলাম অর্নবকে ও তার মাকে বললাম সব। অর্পিতা স্কুলে থাকায় আর দেখা হলো না। কিছুদিন পর সকালে ফোনের রিং-টনে ঘুম ভাঙলো। মিষ্টি কন্ঠে- আমি অর্পিতা। অর্নব আপনার সাথে কথা বলবে। 

হ্যালো, ভাইয়া আপনার মিষ্টির নিমন্ত্রণ। আপুর চাকরী হয়ে গেছে। আগামী ১ তারিখ জয়েন্ট করবে। আপনার আসতে হবে কিন্তু।

আসবো নিশ্চই অর্নব। বলে ফোন রেখে দিলাম।

প্রায় কথা হয় অর্পিতার সাথে। আজ শনিবার অর্নব অর্পিতার নিমন্ত্রণে গেলাম। মিষ্টি আর তার মায়ের হাতের মজাদার সুস্বাদু খাবার খেলাম। যেন অমৃত স্বাদ। আগামী ১ তারিখ থেকে নতুন কর্মজীবন শুরু অর্পিতার। তাই সবাই বেশ খুশি। আমি আর অর্পিতা যখন বসে গল্প করছিলাম, কবুতর দু’টা একটি অন্যটিকে গলায় গলা মিলিয়ে আদর করছিলো। অর্পিতা বললো, এই যে মশাই এদিকে না ঐ দিকে। আমি তাকাতেই কবুতর দুটা লাফ দিয়ে উঠলো। যেন লজ্জা পেয়েছে।

| লেখক : জয়নাল আবেদীন
বিজ্ঞাপন

জনপ্রিয় সংবাদ