Advertisement (Custom)

বিজ্ঞাপন
প্রকাশিত: শনিবার, ৭ মে, ২০২২
সর্বশেষ সংষ্করণ 2022-05-07T03:10:07Z
সিলেট

জাফলংয়ে পর্যটকদের টাকা দিতে হয় কেন?

বিজ্ঞাপন

ডেস্ক রিপোর্ট : সিলেটের সীমান্তবর্তী পর্যটনকেন্দ্র জাফলংয়ে অনেক বছর ধরে ঘুরতে যান দেশের নানা প্রান্তের মানুষ। তারা বিনা মূল্যেই উপভোগ করেছেন সেখানকার প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্য, তবে গত বছর থেকে জাফলংয়ে প্রবেশে চালু করা হয়েছে ফি।

সেপ্টেম্বরে ১০ টাকার টিকিট চালুর পর থেকে অনেকেই এর সমালোচনা করেন। উন্মুক্ত স্থান ঘুরতে টাকা কেন লাগবে, তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। 

জাফলংয়ের টিকিট কাউন্টারে বৃহস্পতিবার দুপুরে পর্যটকদের মারধরের ঘটনার পর আবারও টিকিটের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। অনেকেই একে প্রশাসনের চাঁদাবাজি বলে অভিযোগ করছেন। 

জাফলংয়ের অবস্থান সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায় ভারতের খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে। পাহাড়ের বুকে আছে নদী ও ঝরনা, যার পানিতেই তৈরি হয়েছে জাফলং। স্বচ্ছ পানির নিচে দেখা যায় নানা আকার ও রঙের পাথর। 

সীমান্তের ওপারে ডাউকি নদীর ওপর আছে ঝুলন্ত সেতু, যা দুটি পাহাড়কে যুক্ত করেছে। প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক এখানে আসেন। পর্যটকদের ভিড় সবচেয়ে বেশি থাকে সীমান্তে জিরো পয়েন্ট এলাকায় ডাউকি নদীতে। 

গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রশাসন জিরো পয়েন্ট এলাকায় যাওয়ার জন্য প্রবেশ ফি চালু করে। এ জন্য বসানো হয় একাধিক টিকিট কাউন্টার। অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পান কিছু কর্মী। তারা প্রতিটি দর্শনার্থীর কাছ থেকে ১০ টাকা করে ফি নেন। 

বৃহস্পতিবার দুপুর ২টার দিকে টিকিট কেনা নিয়ে পর্যটকদের সঙ্গে কাউন্টারে থাকা উপজেলা প্রশাসনের কর্মীদের বাগ্‌বিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে ওই কর্মীরা লাঠি দিয়ে পর্যটকদের মারধর করেন। ওই সময় কয়েকজন নারীকেও লাঞ্ছিত করেন তারা। 

সে সময়ের বেশ কিছু ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে সমালোচনা শুরু হয়। 

জাফলংয়ে প্রবেশে টিকিট কেন 

আগে পর্যটকরা জাফলং জিরো পয়েন্টে যেতেন বল্লাঘাট এলাকা দিয়ে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখন গুচ্ছগ্রাম এলাকা দিয়ে পর্যটক প্রবেশের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পর্যটকদের ওঠানামার সুবিধার জন্য বানানো হয়েছে সিঁড়ি। আর গুচ্ছগ্রামে বিজিবি ক্যাম্পের পাশেই বসানো হয়েছে টিকিট কাউন্টার। 

কাউন্টারের পাশে টানানো সাইনবোর্ডে লেখা, ‘জাফলং পর্যটন এলাকার উন্নয়ন ও পর্যটন সেবা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জেলা পর্যটন কমিটি ও উপজেলা পর্যটন কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পর্যটক প্রবেশে পর্যটকপ্রতি ১০ টাকা হারে ফি নির্ধারণ করা হলো।’ 

সাইন বোর্ডের নিচে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) নাম আছে। তাদের একজন জেলা পর্যটন কমিটির; অন্যজন উপজেলা পর্যটন কমিটির সভাপতি। 

এই সাইনবোর্ডের ছবি বৃহস্পতিবার ফেসবুকে শেয়ার দিয়ে সাংবাদিক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট আরিফ জেবতিক লেখেন, ‘কোন আইনে চাঁদাবাজি, প্রশাসন জবাব চাই।’ 

পর্যটকদের মারধরের ঘটনায় ফেসবুকে দেয়া আরেক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘জাফলংয়ের ঘটনার কারণে যেটা বেরিয়ে এসেছে, সেটা হলো সারা দেশে একটু বেড়ানোর মতো সব জায়গায় প্রশাসনের মদদে ও তত্ত্বাবধানে এক নীরব চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে।’ 

প্রবেশ ফি চালুর বিষয়ে গোয়াইনঘাটের ইউএনও তাহমিলুর রহমান বলেন, ‘গত বছর জেলা পর্যটন কমিটির সভায় ফি চালুর সিদ্ধান্ত হয়। উপজেলা প্রশাসন এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করছে। এটি কাউকে ইজারা দেয়া হয়নি। চুক্তিভিত্তিক কিছু কর্মীর মাধ্যমে উপজেলা প্রশাসন ফি আদায় করে। এটাকে আমি অন্যায় মনে করি না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই এই সিস্টেম আছে।’ 

পর্যটকদের সেবার মান বাড়াতেই এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘১০ টাকার বিনিময়ে আমরা পর্যটকদের কয়েকটি সেবা দিই। পর্যটন এলাকায় ড্রেস চেঞ্জ করার রুম ও টয়লেট করা হয়েছে। পর্যটকরা এগুলো বিনা মূল্যে ব্যবহার করতে পারেন। সেই সঙ্গে রয়েছে ফ্রি ওয়াইফাই ব্যবস্থা। এ ছাড়া প্রবেশ ফি দিয়ে পর্যটন এলাকা পরিচ্ছন্ন রাখারও কাজ করা হয়। 

‘টিকিট দেখালে পর্যটকরা সহজে ও নির্ধারিত দামে ফটোগ্রাফার, ট্যুর গাইড ও নৌকার মাঝি পান।’ 

এসব সেবা নিয়ে নানা অভিযোগ ও অসন্তোষ আছে পর্যটকদের মধ্যে। রিয়াজ আহমদ নামের এক পর্যটক বলেন, ‘চেঞ্জরুম আর টয়লেটের সংখ্যা খুব কম। এগুলো তেমন পরিষ্কারও নয়। আর ফ্রি ইন্টারনেট এতটাই স্লো যে ব্যবহার করা যায় না।’ 

ফি নেয়ার বিষয়ে পর্যটন খাতের পরামর্শক হাসান মোরশেদের প্রশ্ন, ‘তারা কোন আইনের ভিত্তিতে এভাবে টাকা সংগ্রহ করছেন? জেলা বা উপজেলা প্রশাসন চাইলেই কি যেকোনো জায়গা থেকে মানুষজনের কাছ থেকে টাকা আদায় করতে পারে? 

‘আমি বাংলাদেশের একজন নাগরিক। আমার ইচ্ছে হলো বাংলাদেশের কোনো একটি খোলা জায়গায় গিয়ে দাঁড়াব। এ জন্য কি প্রশাসন আমার কাছে টাকা দাবি করতে পারে?’ 

মোরশেদ বলেন, ‘পর্যটন খাতের উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য সরকারের আলাদা মন্ত্রণালয় আছে। পর্যটকদের সেবা দেয়ার জন্য সরকারের আলাদা বরাদ্দ আছে। এই টাকা দিয়ে পর্যটন খাতের উন্নয়ন করা হবে। পর্যটকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নয়। 

‘তা ছাড়া কোনো পর্যটনকেন্দ্র থেকে ফি নিতে হলে সরকার এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মচারী এভাবে টাকা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না।’ 

জেলা প্রশাসক দর্শনার্থীর কাছ থেকে ফি আদায়ের সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে জানান জেলা প্রশাসক মজিবর রহমান। 

তিনি বলেন, ‘পর্যটন কমিটির সিদ্ধান্তে এটি করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক তার কমিটির অন্য সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এই ফি আদায় অবৈধ নয়।’ 

পর্যটকদের মারধরের পর প্রবেশ ফি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ঈদে মানুষ যেন আনন্দের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করতে পারে, তাই শুক্রবার থেকে সাত দিন প্রবেশ ফি বন্ধ রাখতে নির্দেশ দিয়েছি।’ 

প্রতিদিন কত টাকা আদায় 

জাফলংয়ে প্রতিদিন পর্যটক ফি বাবদ কত টাকা ওঠে এবং এ টাকা কোন কোন খাতে ব্যয় হয় তার হিসাব দেয়ার দাবি জানান হাসান মোরশেদ। 

জাফলংয়ের একটি রিসোর্টের মালিক জানান, প্রতিদিন কয়েক শ পর্যটক এখানে বেড়াতে আসে। ছুটির দিন আসে কয়েক হাজার। আর ঈদের মতো বড় ছুটিতে পর্যটক সংখ্যা লাখ ছাড়ায়। 

ইউএনও তাহমিলুর বলেন, ‘টিকিট ফি থেকে প্রতিদিন সমান টাকা ওঠে না। একেক দিন একেক রকম হয়। আমি দিনে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা আদায় হতে দেখেছি। 

‘জাফলং পরিষ্কার রাখাসহ পর্যটকদের সেবা দেয়ার জন্য কিছু অস্থায়ী কর্মী রাখা হয়েছে। এই টাকায় ঘণ্টাপ্রতি ৫০ টাকা হিসাবে তাদের বেতন দেয়া হয়। কর্মীর সংখ্যা নির্দিষ্ট নয়। সর্বনিম্ন পাঁচ-ছয়জন থেকে সর্বোচ্চ ৩০ জন কাজ করেন।’ 

তিনি জানান, উপজেলা পর্যটন কমিটি নামে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট টাকা আছে। এই অ্যাকাউন্টে প্রবেশ ফি জমা হয়। ইউএনও ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করেন। এখন পর্যন্ত ৪০ লাখ টাকা জমা হয়েছে। 

কারা এই স্বেচ্ছাসেবক 

জাফলংয়ে পর্যটকদের মারধরের ভিডিওতে যাদের মারতে দেখা যায়, তাদের সবার গায়ে স্বেচ্ছাসেবক লেখা ও উপজেলা প্রশাসনের লোগোওয়ালা অ্যাপ্রোন ছিল। 

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, ‘যারা পর্যটকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করছে, তারা কীভাবে স্বেচ্ছাসেবক হয়? বৃহস্পতিবার তারা যে আচরণ করেছে, তাতে মনে হয়েছে এরা প্রশাসনের লাঠিয়াল। 

‘চাঁদা নিয়ে যদি প্রাকৃতিক স্থানগুলো স্থানীয়ভাবে পরিচালনা করতে হয়, তাহলে পর্যটন উন্নয়নে সরকারের কাজ কী?’ 

কিমের অভিযোগ, ‘শুধু চাঁদা আদায় নয়, জাফলংয়ে খাস জমিতে প্রশাসনের মদদেই শত শত দোকান বসানো হয়েছে। এখান থেকে প্রশাসনের কর্তারা টাকা পান।’ 

স্বেচ্ছাসেবক প্রসঙ্গে ইউএনও বলেন, ‘স্বেচ্ছাসেবক বলা হলেও আসলে তারা স্বেচ্ছাসেবক নন। সম্মানির বিনিময়ে চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন। অন্যদের থেকে তাদের আলাদা করার জন্য অ্যাপ্রোন দেয়া হয়েছে।’
বিজ্ঞাপন

জনপ্রিয় সংবাদ