Advertisement (Custom)

বিজ্ঞাপন
প্রকাশিত: শুক্রবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২১
সর্বশেষ সংষ্করণ 2022-02-07T18:32:22Z
জানা-অজানাধর্ম ও জীবন

হাজার হাজার বছরেও কমেনি জমজম কূপের পানির উচ্চতা !

বিজ্ঞাপন

ডেস্ক রিপোর্ট : প্রায় চার হাজার বছর আগের কথা। খলিলুল্লাহ হজরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর পক্ষ থেকে একের পর এক কঠিন পরীক্ষা হয়েছিলেন। মহান আল্লাহর দয়ায় প্রতিটি পরীক্ষায়ই তিনি উত্তীর্ণ হন। মহান আল্লাহ তাঁর বন্ধু ইবরাহিমকে দীর্ঘদিন দোয়ার পর ৮৬ বছর বয়সে একটি চাঁদের টুকরোতুল্য পুত্রসন্তান দান করেন।

যার নাম হজরত ইসমাঈল (আ.)। যার আলোয় আলোকিত হয়ে গিয়েছিল হজরতে ইবরাহিম (আ.)-এর ঘর। কিন্তু আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ এলো, প্রিয় পুত্র ইসমাইল ও স্ত্রী হাজেরা (আ.)-কে আরবের জনমানবহীন মরুর বুকে নির্বাসনে দিয়ে আসার। আল্লাহর মহান হুকুম পালনার্থে ইবরাহিম (আ.) তাঁর পরিবারকে নির্বাসন দিতে নিয়ে এলেন ধু-ধু মরীচীকাময় আরবের একটি উপত্যকায়।

যেখানে শাম থেকে ইয়েমেন যাতায়াতকারী বাণিজ্য কাফেলা ছাড়া আর কেউ তাঁবু স্থাপন করত না। বছরের বেশিরভাগ সময়েই এ অঞ্চলটি এমন বিরান হয়ে থাকত, যে এখানে কোনো পাখিরও দেখা মিলত না। এই নিদারুণ পরিস্থিতি দেখে হজরত ইবরাহিমের হৃদয় থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। কিন্তু এই কঠিন বিপদেও তাঁর পূর্ণ আস্থা ছিল মহান আল্লাহর ওপর।

তিনি তাঁর বাহন হিসেবে ব্যবহৃত পশুর লাগাম ধরে অশ্রুসজল চোখে পরিবারের জন্য দোয়া করলেন, ‘হে প্রভু, এ স্থানকে নিরাপদ শহর ও জনপদে পরিণত কর। এর অধিবাসীদের মধ্য থেকে যারা মহান আল্লাহ ও শেষ বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে, তাদের বিভিন্ন ধরনের ফল ও খাদ্য রিজিক হিসেবে প্রদান করো’ (সূরা : বাকারা-১২৬)।

স্ত্রী-পুত্রকে নির্বাসনে রেখে হজরত ইবরাহিম (আ.) চলে যাওয়ার অল্প কিছু সময় পরই হজরত হাজেরা (আ.)-এর খাদ্য ও পানি শেষ হয়ে যায়। অনাহারের দরুন শুকিয়ে যায় মা হাজেরা (আ.)-এর স্তন্য। পানির তৃষ্ণায় হজরত ইসমাইল (আ.) কাতর হয়ে পড়লেন।

তাঁর করুণ কান্নায় মা হাজেরা (আ.) দিশাহারা হয়ে পড়লেন। তিনি এদিক-ওদিক দৌড়াদৌড়ি করতে লাগলেন। সাফা পাহাড়ের শুভ্র মরীচীকাকে পানির নহর ভেবে দৌড়ে গেলেন সেখানে। কিন্তু দেখলেন, তফত বালুকাময় প্রান্তর ছাড়া সেখানে আর কিছুই নেই। সাফা পাহাড় থেকে মারওয়ায় তাকিয়ে ভাবলেন, সেখানে বইছে স্বচ্ছ পানির স্রোতধারা। তাই দৌড়ে গেলেন সেখানে। কিন্তু সেখানেও মরীচীকা ছাড়া কিছু পেলেন না তিনি। প্রিয় সন্তানের তৃষ্ণা মেটাতে এক কোশ পানির আশায় সাফা থেকে মারওয়া ও মারওয়া থেকে সাফা পাহাড়ে তিনি সাতবার দৌড়াদৌড়ি করলেন। অবশেষে মহান আল্লাহ তাঁর বন্ধু হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর দোয়া কবুল করলেন। পুত্র ইসমাইল (আ.) কাছে এসে মা হাজেরা (আ.) দেখতে পেলেন, হজরত ইসমাইল (আ.)-এর পায়ের তলদেশ থেকে বইছে স্বচ্ছ পানির ফোয়ারা। যা পরবর্তী সময় জমজম কূপ নামে পরিচিতি লাভ করে।

পৌত্তলিক যুগে জুরহাম গোত্র-খোজায়া গোত্র কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত ও বিতাড়িত হয়ে মক্কা ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় এ কুয়ায় তারা মাটি ভরাট করে দেয়। এর প্রায় সাড়ে ৪০০ বছর পর স্বপ্নযোগে আদিষ্ট হয়ে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে আবদুল মুত্তালিব স্বীয় পুত্র হারেসকে সঙ্গে নিয়ে তা আবার খনন করেন।

পবিত্র কাবা শরিফ থেকে ২০ মিটার বা ৬৬ ফুট (মতান্তরে ২১ মিটার) পশ্চিমে মসজিদে হারামের ভিতরেই এই কূপের অবস্থান। প্রায় ১৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৪ ফুট চওড়া একটি আয়তক্ষেত্রের মতো কূপটি। যার গভীরতা ৩০ মিটার বা ৯৮ ফুট। (মতান্তরে ১২০ বা ১৪০ ফুট)। ঐতিহাসিক তথ্য অনুসারে, এই কূপের ছিল দুটি জলাধার। একটি হচ্ছে খাওয়ার জন্য। অন্যটি অজু করার জন্য।

‘জমজম’ নাম কীভাবে এলো?

জমজম কূপের নামকরণের ইতিহাস নিয়ে নানা মত রয়েছে। কারও কারও মতে, হিব্রু ভাষায় ‘জমজম’ অর্থ থাম-থাম। মা হাজেরা (আ.) পানির প্রবাহ রোধ করার জন্য বাঁধ নির্মাণের সময় বলেছিলেন, ‘জমজম’- থাম-থাম। আল্লাহর ইচ্ছায় তা নির্দিষ্ট স্থানে থেমে গেল।

আরব্য ঐতিহাসিকদের মতে, ‘জমজম’ অর্থ অধিক হওয়া। এখানে পানির আধিক্যের কারণেই এর নামকরণ করা হয়েছে ‘জমজম’।

গবেষকরা মনে করেন, ‘জমজম’ অর্থ সমবেত হওয়া। মা হাজেরা (প্রকৃতপক্ষে হাজেরা (আ.) ডানে-বাঁয়ে পানির প্রবাহ রোধ করে মাটির বাঁধ দিয়ে পানি সঞ্চিত করে রেখেছেন বলে একে ‘জমজম’ বলা হয়।

আল্লামা মাসউদি (রহ.) বলেন, প্রাচীনকালে ঘোড়া এ কূপ থেকে পানি পান করেছিল। পানি পানের সময় ঘোড়ার আওয়াজকে ‘জমজম’ বলা হয়। সে হিসেবে এ কূপকে ‘জমজম’ নামে নামকরণ করা হয়েছে। 

এই কূপের অলৌকিকতা : সৌদি আরবের ভূতাত্ত্বিক জরিপ বোর্ডর অধীনে জমজম কূপের ওপর একটি গবেষণাকেন্দ্র রয়েছে। তাদের ভাষ্য মতে, জমজমের পানির স্তর ভূপৃষ্ঠের প্রায় ১০.৬ ফুট নিচে। প্রতি সেকেন্ডে ক্রমাগত আট হাজার লিটার হারে ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে পাম্প করা হয়। তখন পানির পর্যায় ভূপৃষ্ঠের প্রায় ৪৪ ফুট নিচে নেমে যায়। কিন্তু যখন পাম্প করা বন্ধ করা হয়, তখন এর পর্যায় মাত্র ১১ মিনিটে আবার ১৩ ফুট উচ্চতায় ফিরে আসে। প্রতি সেকেন্ডে আট হাজার লিটার মানে প্রতি মিনিটে চার লাখ ৮০ হাজার লিটার পানি উত্তোলন করা হয়। সে হিসেবে প্রতি ঘণ্টায় ২৮.৮ মিলিয়ন লিটার এবং প্রতিদিন ৬৯১.২ মিলিয়ন লিটার পানি উত্তোলন করা হয়। নিশ্চয়ই এটা আল্লাহর কুদরতের একটি বড় নিদর্শন। 

এই পানির বিশুদ্ধতা : পবিত্র জমজম নিয়ে রসুল (সা.)-এর বহু হাদিস রয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো ইবনে আব্বাস (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ পানি হলো জমজমের পানি। তাতে রয়েছে তৃপ্তির খাদ্য এবং ব্যাধির আরোগ্য। ’ (আল মুজামুল আউসাত, হাদিস : ৩৯১২) 

বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে জমজম : জাপানের বিখ্যাত গবেষক মাসরু এমোটো জমজমের পানি নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁর মতে, সাধারণ পানির এক হাজার ফোঁটার সঙ্গে যদি জমজমের পানির এক ফোঁটা মেশানো হয়, তাহলে সেই মিশ্রণও জমজমের পানির মতো বিশুদ্ধ হয়। জমজমের পানির মতো বিশুদ্ধ পানি পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না। 

জমজম কূপের বর্তমান চিত্র : বাদশাহ আবদুল আজিজ বিন সৌদের হাতে বর্তমানে জমজম কূপ আধুনিক রূপ নিয়েছে। কূপের পূর্ব ও দক্ষিণে পানি পান করানোর জন্য দুটি স্থান নির্মাণ করেন তিনি। দক্ষিণ দিকে ছয়টি এবং পূর্বদিকে তিনটি ট্যাপ লাগান। কাবাঘরের ২১ মিটার দূরে অবস্থিত কূপটি থেকে ২০ লক্ষাধিক ব্যারেল পানি প্রতিদিন উত্তোলিত হয়। কূপটি বর্তমানে আন্ডারগ্রাউন্ডে রয়েছে। কূপের পানিবণ্টনের জন্য ১৪০৩ হিজরিতে সৌদি বাদশাহর এক রাজকীয় ফরমান অনুযায়ী হজ মন্ত্রণালয়ের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ইউনিফায়েড ‘জামাজেমা দফতর’ গঠিত হয়। এই দফতরে একজন প্রেসিডেন্ট, একজন ভাইস প্রেসিডেন্টসহ মোট ১১ জন সদস্য ও পাঁচ শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারী নিয়োজিত আছেন। 

জমজমের পানির ফজিলত : রসুল (সা.)-এর ‘সাক্কে ছাদার’ বা বক্ষবিদীর্ণ করে হজরত জিবরাইল (আ.) জমজমের পানি দিয়ে তা ধৌত করেন (বোখারি-৩৩৪২)। 

রসুল (সা.) বলেন, ‘ভূপৃষ্ঠের মধ্যে সর্বোত্তম পানি জমজমের পানি। তাতে ক্ষুধার্ত ব্যক্তির খাদ্য ও অসুস্থ ব্যক্তির আরোগ্য রয়েছে’ (তাবরানি-১১১৬৭)। 

সাহাবাগণ ও পূর্বের মনীষীগণ মেহমানদের জমজমের পানি উপহার দিতেন (আখবারে মক্কা)। 

রসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে উদ্দেশ্যে জমজমের পানি পান করা হয়, আল্লাহতায়ালা তা কবুল করেন’ (আহমদ, ইবনে মাজাহ)। 

জমজমের পানি পানের নিয়ম :

১. দাঁড়িয়ে পান করা 

২. তিন শ্বাসে পান করা 

৩. পানের সময় এই দোয়া পড়া 

উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা ইলমান নাফিআ, ওয়া রিজকান ওয়াসিয়া, ওয়া শিফাআন মিন কুল্লি দা-ইন। ’ 

অর্থ : ‘হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে কল্যাণকর জ্ঞান, প্রশস্ত রিজিক এবং যাবতীয় রোগ থেকে আরোগ্য কামনা করছি’ (দারা কুতনি : ৪৬৬)।
বিজ্ঞাপন

জনপ্রিয় সংবাদ