Advertisement (Custom)

বিজ্ঞাপন
প্রকাশিত: সোমবার, ১৩ জুলাই, ২০২০
সর্বশেষ সংষ্করণ 2020-07-13T14:12:26Z
গোলাপগঞ্জ

গোলাপগঞ্জে ঘরবন্দি শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশেষজ্ঞরা

বিজ্ঞাপন


ফাহিম আহমদ, গোলাপগঞ্জ :: সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলার ১নং ফুলবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র সৌরভ। একসময় বিদ্যালয়ের পড়া, প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়া, বিকেলে খেলা, আবার সুযোগ পেলেই দুরন্তপনায় মেতে ওঠা সৌরভ এখন ঘরবন্দি। স্কুল বন্ধ, প্রাইভেট শিক্ষকও আসেন না, দুরন্তপনায় মেতে ওঠা হয় না তার গত প্রায় ৩ মাস যাবত। সবুজ ঘাসের উপর খেলার সুযোগও নেই তার। দিনের অধিকাংশ সময় কাটে মোবাইলে কিংবা কম্পিউটারে গেমস খেলে।

কেবল সৌরভই নয়, উপজেলার ১৮০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৫৬টি কিন্ডারগার্টেন মিলে প্রায় ৪০ হাজার শিশুর এখন একই অবস্থা। কেবল স্কুল নয়, উপজেলার মক্তবগুলোতে পড়ুয়া আরও কয়েক হাজার শিশু শিক্ষার্থীর সবাই এখন ঘরবন্দি। বড়রা যখন স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রয়োজনে বাইরে বের হতে পারছেন, তখন করোনা মহামারির হাত থেকে নিজের শিশুকে নিরাপদে রাখতে তাদের ঘরের বাইরে বের হতে দিচ্ছেন না অভিভাবকরা। এমনকি পাড়ার অন্য সহপাঠীদের সাথেও মেশা হচ্ছে না শিশুদের।

এ অবস্থায় শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞদের মতে, মুক্ত আকাশের নিচে দুরন্তপনায় মেতে ওঠা শিশুটি চার দেয়ালের ভেতর বন্দি থাকতে থাকতে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। দেখা দিতে পারে মানসিক অশান্তি, উদ্বিগ্নতা ও দুশ্চিন্তা। যেটাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ‘পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার বলে।’

গোলাপগঞ্জ উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ১৮০টি আর কিন্ডারগার্টেন রয়েছে প্রায় ৫৬টি। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ৩০ হাজারের অধিক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করেন আর কিন্ডারগার্টেনগুলোতে প্রায় ৪ হাজারের অধিক শিক্ষার্থী। সব মিলিয়ে স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪০ হাজারের মতো। সকল শিক্ষার্থীর বয়স ১০ বছরের নিচে। অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, উপজেলায় প্রায় শতাধিক মাদরাসা ও মক্তব মিলে প্রায় ১০ হাজার শিশু পড়ালেখা করছে। সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ হাজার শিশুই এখন ঘরবন্দি।


একসময় এসব শিশুরা দিনে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি সহপাঠীদের সাথে সময় কাটাত। কেউ কেউ ব্যক্তিগত শিক্ষকের কাছেও পড়ত। বিকেলে খেলাধুলা কিংবা সৃজনশীল কাজ হিসেবে ছবি আঁকা, গান শেখাসহ নানা কাজে লিপ্ত থাকলেও তারা এখন অলস সময় যাচ্ছে। তাই দিনের অধিকাংশ সময়ই তারা পড়ে থাকে ভার্চুয়াল জগতে। এ থেকে শিশুর বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এমনকি কোনো কোনো শিশু মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

কেবল তাই নয়, অনেক মা-বাবা আছেন যারা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। তাই তাদের নিয়মিত বাইরে যেতে হয়। ফলে ঘরে ফিরে নিজের শিশুর নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় সন্তানকে কাছেও নিতে পারছেন না তারা।

গোলাপগঞ্জ বাজারে অবস্থিত কাপড়ের দোকানের মালিক ব্যবসায়ী আব্দুস সালাম। তার মেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। একসময় বাবা মেয়ের ইচ্ছামতো মেলামেশা হলেও এখন সেটা অনেকটা নিয়মের শিকলে বাঁধা। প্রতিদিন ব্যবসার জন্য গোলাপগঞ্জ বাজারে আসার কারণে ঘরে গিয়ে নিজের মেয়ের সাথে মিশতে পারেন না। কাছে নিয়ে মেয়েকে আদর করতে পারেন না। তিনি বলেন, ‘মেয়েটা বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাইরেও বের হতে পারছে না। স্কুলও বন্ধ। তবুও সকলে মিলে যতটুকু সম্ভব সঙ্গ দেওয়ার চেষ্টা করছি, যাতে তার মন ভালো থাকে।’

তবে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাইকিয়াট্রি বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. আর কে এস রয়েল। তিনি বলেন, ‘একটা সময় শিশুর সময় কাটানোর অনেক মাধ্যম ছিল। কিন্তু বর্তমানে সে বেকার। এর মাধ্যমে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়ে নানা সমস্যা হতে পারে। তাই শিশুদের বাসায় পড়ানো, অন্য কাজে ব্যস্ত রাখা যেমন- ছবি আঁকা, গান শেখা, নাচ শেখা কিংবা তার নিজের ইচ্ছায় বাড়ির আঙিনায় দুরন্তপনায় মেতে উঠতে দেওয়া বা যেসব খেলাধুলায় স্বাস্থ্যবিধি বজায় থাকে যেমন ক্যারম খেলানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কার্টুন দেখানো যেতে পারে যাতে তার মন ভালো থাকে।’

শিশুদের করোনা মহামারি সম্পর্কে সচেতন করে তোলার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘শিশুদের সংবাদ দেখা কিংবা পাঠ করা থেকে আপাতত বিরত রাখতে হবে। তা নাহলে মৃত্যু কিংবা আক্রান্তের সংবাদ তার মনে ভিতি তৈরি করতে পারে। তবে তাকে করোনা থেকে কিভাবে নিরাপদে থাকা যায়, স্বাস্থ্যবিধিতে ব্যবহার্য পিপিই, মাস্ক, গ্লাভস এগুলোর ব্যবহার কিভাবে করতে হয়, কেন নিয়মিত হাত ধুতে হয় ইত্যাদি বিষয় জানানো জরুরি।’

এ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘শিশু মোবাইল কিংবা কম্পিউটার গেমস খেলতে চাইলে একেবারে বিরত রাখা যাবে না। কিছু খেলতে দিলে তার সময়টা ভালো কাটবে। কিন্তু বেশি পরিমাণে না। শিশু এসব গেমসে আকৃষ্ট হয়ে গেলে সমস্যা হবে।’

ডা. আর কে এস রয়েল বলেন, ‘সম্ভব হলে পাড়ির পাশাপাশি যেসব স্থানে জনসমাগম নেই সেসব জায়গায় শিশুকে নিয়ে বিকেলে কিছু সময় ঘোরা যেতে পারে। অভিভাবকরা শিশুর সাথে কিছু সময় খেলা করতে পারেন।’ শিশুর সাথে সবসময় ভালো ব্যবহারের পরামর্শ দেন এ বিশেষজ্ঞ।

তবে স্কুল বন্ধ থাকলেও শিক্ষকরা ফোনে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সাথে যোগাযোগ রাখছেন এবং পাঠ বুঝিয়ে দিচ্ছেন বলে জানান উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা দেওয়ান নাজমুল আলম। তিনি বলেন, ‘উপজেলায় ১৮০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৩৫ হাজারেরও বেশি ও প্রায় ৫৮টি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে প্রায় ৪ হাজার মিলিয়ে প্রায় ৩৯ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। সেই সকল শিক্ষার্থীদের আমাদের শিক্ষকরা বাড়িতে থেকে তাদেরকে ফোনকলের মাধ্যমে দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। একদিন এক পাঠ বলে দিয়ে পরদিন আবারও ফলোআপ করছেন।’

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মনিসর চৌধুরী বলেন, ‘করোনাকালে স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুরা বাড়ির বাইরে বের হতে পারছে না। বন্ধুদের সাথে মিশতে পারছে না। সব ধরণের বিনোদন কেন্দ্র বন্ধ। তারা বর্তমানে ঘরবন্দি। এসময় অভিভাবকদের উচিত তাদের সাথে সবসময় ভালো ব্যবহার করা। তারা একসময় হয়তো ভালো না লাগার কারণে বাড়তি দুষ্টুমি করবে। এতে অভিভাবকদের তাদের উপর চড়াও হওয়া যাবে না।’

তিনি বলেন, ‘এই সময়টায় শিশুরা যাতে মানসিক চাপে না ভোগে সেটা লক্ষ্য রাখতে হবে। তাদের ছোটখাটো আবদার পূরণ করা দরকার। শিশুরা যে বিষয়টা পছন্দ করে সে বিষয় নিয়ে তাদের সাথে আলোচনা করা যেতে পারে। কোনো অবস্থাতেই তাদেরকে আঘাত করা যাবে না। কারণ আপনার অতিরিক্ত বকাঝকা শিশুকে মানসিকভাবে দূর্বল করতে পারে অথবা তার দুষ্টুমি বেড়ে যেতে পারে। এতে করে এই কঠিন সময় আরও দুর্বিষহ হতে পারে।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মামুনুর রহমান বলেন, ‘দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকার কারণে শিশুরা বাড়ি থেকে বের হতে পারছে না। এ সময় তারা কিছুটা মানসিক চাপে ভুগতে পারে। যদি এক সপ্তাহ স্কুল বন্ধ থাকে তবে সেটা আনন্দের। এ সময় তাদের উচিত বাড়িতে থেকে হাতের কাজ শেখা। তারা বাড়িতে ছবি আঁকতে পারে। বাড়ির আঙিনায় ফল বা ফুল গাছ লাগাতে পারে।’ নানাভাবে তাদের ব্যস্ত রাখার মধ্য দিয়ে সময়টা পার করার পরামর্শ দেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘এই সময়টা মা-বাবাকে তাদের প্রতি একটু বেশি মনোযোগ দিতে হবে। তারা যাতে সাজেশন অনুযায়ী বাড়িতে থেকে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তাদের উপর বাড়তি কোনো কিছু চাপিয়ে না দেওয়ার উচিত।’

বিজ্ঞাপন

জনপ্রিয় সংবাদ